মো: ফজলুল হক মানিক
জেলা প্রতিনিধি।
লালমনিরহাটে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযানঃ ধ্বংসের নাটক, পুর্ণ গঠনের বাস্তবতা
পরিবেশের ক্ষতি, কৃষিজমির উর্বরতা বিনষ্ট এবং আইন অমান্য করে গড়ে ওঠা লালমনিরহাটের অবৈধ ইটভাটাগুলো একের পর এক প্রশাসনের অভিযানেও বন্ধ হচ্ছে না।
কাগজে-কলমে কঠোর অভিযান চালিয়ে ভাটা গুড়িয়ে দেওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। নামমাত্র ধ্বংসের পর আবারও সচল হয়ে উঠছে এসব অবৈধ ইটভাটা।
আলোচিত ৬ অবৈধ ইটভাটার পুনরুত্থান
গত ১২ মার্চ, জেলা প্রশাসনের নির্দেশে কালীগঞ্জ উপজেলার দলগ্রাম শ্রীখাতা এলাকার *এমজেএ-২ ব্রিকস *বিবিএমসি ব্রিকস* হাতীবান্ধার* টিএমএন ব্রিকস* আদিতমারীর* সান টু ব্রিকস* পূর্ব দৌলজোরের* ওয়ান স্টার ব্রিকস* ও
সাপ্টিবাড়ির *এলএমবি ব্রিকস—এই ছয়টি অবৈধ ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে তা ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রশাসনের অভিযানের এক সপ্তাহের মধ্যেই সবগুলো ইটভাটাই আবার সচল হয়ে উঠেছে।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, এসব ভাটার চিমনির সামান্য অংশ ভেঙে দেওয়া হলেও দ্রুত সংস্কার করে পুনরায় কার্যক্রম শুরু করেছে মালিকপক্ষ। স্থানীয়রা বলছেন, প্রশাসনের অভিযান আসলে ‘নামমাত্র’, যা শুধু আইনের চোখে ধুলো দেওয়া ছাড়া কিছুই নয়।
প্রশাসন ও রাজনৈতিক প্রভাবের অদৃশ্যসমীকরণ
লালমনিরহাটের ৫৫টি ইটভাটার মধ্যে ৩২টি সম্পূর্ণ অবৈধ, যাদের কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রহীন এসব ভাটার বেশির ভাগই উচ্চ আদালতে রিট
পিটিশন করে চালু রেখেছে। প্রশাসন অভিযান চালালেও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মালিকরা এসব অবৈধ ইটভাটা সচল রাখছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা দাবি করে আগে আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় ব্যবসা করেছে অনেক ইটভাটা মালিক। এখন বিএনপির রাজনীতির আশ্রয়ে গিয়ে তারা ভাটাগুলো সচল রাখার কৌশল নিয়েছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকার কারণে প্রশাসনও কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
একটি অভিযানে অংশ নেওয়া ম্যাজিস্ট্রেট নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা অভিযান চালাই, ভাটাগুলো আংশিক ধ্বংস করি, কিন্তু রাজনৈতিক চাপে পরে তা আবার চালু হয়ে যায়। অনেক সময় স্থানীয় প্রশাসনও এই প্রভাবের কারণে দুর্বল অবস্থানে থাকে।
পরিবেশ ও কৃষিজমির উপর বিপর্যয়কর প্রভাব
স্থানীয় কৃষকরা জানান, এসব ইটভাটা আশপাশের উর্বর কৃষিজমির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। সফলি জমির
উর্বর মাটি (টপ-সয়েল) কেটে নিয়ে ইট তৈরি করায় জমির উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। ফলস্বরূপ কৃষি ফসলের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে এবং কৃষকদের জীবিকা সংকটে পড়ছে।
আদিতমারীর কৃষক রবিউল ইসলাম বলেন, “ভাটার জন্য আমার জমিতে ফসল হয় না। অনেক জায়গায় অভিযোগ দিয়েছি, কোনো লাভ হয়নি। ম্যাজিস্ট্রেটরা আসে, বুলডোজার চালায়, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সব আগের মতো হয়ে যায়।”
প্রশাসনের দাবি বনাম বাস্তবতা
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক* এইচএম রকিব হায়দার* বলেন, “অবৈধ ইটভাটা বন্ধে আমরা কঠোর। বুলডোজার
দিয়ে সব ধ্বংস করা হয়েছে। কেউ যদি পুনরায় চালু করে, তথ্য দিলে আবার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও ধ্বংস করা ভাটাগুলো পুনরায় সচল থাকার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
স্থানীয়দের দাবি, প্রশাসন যেন ‘নাটকীয় অভিযান’ চালিয়ে দায় সারে, অথচ মূল অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না।
স্থানীয়দের দাবি: সম্পূর্ণ উচ্ছেদ ও কঠোর ব্যবস্থা
পরিবেশের সুরক্ষা এবং কৃষিজমি রক্ষায় অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি
জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তারা চান, কেবল চিমনি ভাঙার নাটক না করে ভাটার পুরো কাঠামো ধ্বংস করে দেওয়া হোক, যাতে তা পুনরায় চালু না হতে পারে।
সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়া কোনো ইটভাটা চালানো বেআইনি। কিন্তু রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকার কারণে মালিকপক্ষ আইন অমান্য করে নির্বিঘ্নে ব্যবসা
চালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয়দের দাবি, শুধু অভিযান চালালেই হবে না, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে প্রশাসনকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।
প্রশাসন কি এবার সত্যিই কঠোর হবে, নাকি আরও একবার ‘নাটকীয়’ অভিযান চালিয়ে দায় সেরে নেবে? এই প্রশ্ন এখন সাধারণ মানুষের